সৈয়দ বোরহান কবীর:চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে শ্রীলঙ্কা। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দেশটির নানা দুরবস্থার কথা প্রচারিত হচ্ছে। একটি দেশের মানুষের কষ্ট কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিপর্যয়ে এ দেশের কোনো মহলের মধ্যে চাপা উল্লাস দেখে আমি প্রথমে অবাক হয়ে যাই। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশি দূর যাওয়ার দরকার হয় না। একশ্রেণির সুশীল ও পণ্ডিতের মধ্যে শ্রীলঙ্কা চর্চা শুরু হয়েছে প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে। শ্রীলঙ্কার ঘটনা যেন বিএনপির মরা গাঙে জোয়ার এনেছে। ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পথেই এগোচ্ছে।’ ঋণ করে ঘি খেলে কী হয় তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন প্রতিদিনই কেউ কেউ। অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প দেশের জন্য কী সর্বনাশ ডেকে আনে শ্রীলঙ্কা তার উদাহরণ। এমন উদাহরণ দিয়েই তারা বাংলাদেশকে সতর্ক করেছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশের পরিস্থিতিও শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে মন্তব্য করে মুচকি হাসছেন। শ্রীলঙ্কার ঘটনার পর কেউ কেউ ধরেই নিয়েছেন শিগগিরই বাংলাদেশের পরিস্থিতি এ রকম হতে যাচ্ছে। যারা এ ধরনের মন্তব্য করছেন তাদের মধ্যে কারও আতঙ্ক দেখছি না, দেখছি এক ধরনের বুনো আনন্দ। বাংলাদেশ সরকার বিপদে পড়বে, এ স্বপ্নে কারও কারও যেন ঘুম নেই। ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। বিভিন্ন সময় বাইরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পরপরই সরকারের পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যখন নির্বাচন হয়, তখন ভারতে কংগ্রেস সরকার। বাংলাদেশের নির্বাচনের পরপরই ভারতে নির্বাচন হলো। কংগ্রেস ওই নির্বাচনে হারল। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হলেন নরেন্দ্র মোদি। বিজেপির মতো দক্ষিণপন্থি একটি দল সেক্যুলার ভারতের ক্ষমতা দখল করল। এ সময় বাংলাদেশে দেখলাম উচ্ছ্বাস, মিষ্টি বিতরণ। জানার চেষ্টা করলাম বিজেপি জয়ী হওয়ায় বাংলাদেশে কারও কারও উৎসব কেন? এরা কি বিজেপির সমর্থক? খোঁজ নিয়ে জানলাম, বিজেপি জেতায় খুশি হওয়ার কারণ ভিন্ন। আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠ। কংগ্রেস বিদায় নিয়েছে। তাই বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেবে। মোদি সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটাবে। কি ভাবনা, কি স্বপ্নবিলাস! কিন্তু অচিরেই মিষ্টি বিতরণের পয়সা জলে গেল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র- এই ভেবে যাঁরা আনন্দ মিছিল করেছিলেন, খুব সহসাই তাঁরা হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। দ্রুতই বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক আরও গভীর হলো। এভাবে সারাক্ষণই কিছু মানুষ যেন ওত পেতে থাকে, বিদেশি কেউ এসে আওয়ামী লীগকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে। এমন কিছু বিদেশে ঘটবে তার আঁচ আওয়ামী লীগ সরকারে এসে লাগবে। পাকিস্তানে সংকট হলো, কেউ আশায় বুক বাঁধে বাংলাদেশেও কিছু একটা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল। ব্যস। দেশে-বিদেশে একযোগে চোঙা ফোঁকা শুরু হলো। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন অনিবার্য। কবে কীভাবে সরকারের পতন হবে তার বিশদ বিবরণও প্রকাশিত হতে থাকল। এ সরকার কখন কীভাবে বিদায় নেবে তা নিয়ে গত ১৩ বছরে কিছু মানুষ চিন্তা করতে করতে পাগল হয়ে গেছে। পাগল হয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলোকে যেন জীবনীশক্তি দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ পরবর্তী শ্রীলঙ্কা- এমন উচ্চারণ এখন কান পাতলেই শোনা যায়। এমন কথায় অনেকেই আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। আসলে কি তাই?
অদ্ভুতসুন্দর এক দেশ শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা পায় ১৯৪৮ সালে। এরপর দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে উন্নয়নে মন দেয় দেশটি। দ্রুত সব সূচকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেরা হয় শ্রীলঙ্কা। প্রায় শতভাগ শিক্ষিতের দেশ হিসেবে সবার সমীহ আদায় করে। পর্যটন খাত থেকে ভালো আয় শুরু করে নৈসর্গিক বৈচিত্র্যে ভরপুর এ দেশটি। ২০০৬ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি করতে থাকে। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৩৬ ডলার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৮১৯ ডলারে উন্নীত হয়। যা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কা উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার এ উন্নয়নের গল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়নের অভিযাত্রা মেলানোর চেষ্টা করা হয়। ২০০৮ সালে বাংলাদেশও বদলে যেতে শুরু করে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থনীতির সব সূচকে বাংলাদেশ অসম্ভব ভালো করছে। বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার মতো অনেক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার মতোই অনেক ঋণ করেছে। ২০১৫ সালে সেখানে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ছিল ৫ হাজার কোটি টাকার কিছু কম। ২০২২ সালে এসে তা বেড়ে প্রায় লাখ কোটি (৯৭,৭৪০) টাকার কাছাকাছি হয়েছে। দুই দেশের উত্থানের মিল এটুকু। কিন্তু বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার উন্নয়নের গল্প একরকম নয়। বরং সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। শ্রীলঙ্কার পুরো উন্নয়ন ছিল অপরিকল্পিত। জনগণের চাহিদা বিবেচনা করা হয়নি। এ রকম অনেক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল যা ছিল অপ্রয়োজনীয়। যেমন হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর। শ্রীলঙ্কার এ সমুদ্রবন্দর নির্মাণের দরকারই ছিল না। কিন্তু প্রায় ৩১ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে এই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হয়। চীন এ সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য ঋণ দেয় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হারে সুদে। এত উচ্চসুদে ১৫ বছরের জন্য ঋণ নিয়ে বন্দর নির্মাণের পর দেখা গেল এ সমুদ্রবন্দর থেকে আয় হয় সামান্যই। এরপর পরিচালনার জন্য আবার চীনের কাছে হাত পাতে শ্রীলঙ্কা। এবার নেয় প্রায় ৭৬ কোটি ডলার। তাতেও বন্দরে গতি আসে না। ফলে চীনের কাছেই বন্দরটি ইজারা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণের বোঝায় জনগণকে ফেলা হলো বিনা প্রয়োজনে। এ রকম আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ‘মাত্তালা রাজাপক্ষ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। এটি লঙ্কানদের আরেকটি অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প। এও চীনের ঋণে করা। প্রায় জঙ্গলের মধ্যে করা এ বিমানবন্দরে আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। এ বিমানবন্দর ইতোমধ্যে বিশে^ সবচেয়ে ফাঁকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের খেতাব পেয়েছে। এভাবে উদ্ভট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে উচ্চসুদের ঋণে। শ্রীলঙ্কার মেগা প্রকল্প ও বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর তফাত আকাশ-পাতাল। বাংলাদেশের প্রতিটি মেগা প্রকল্প জনস্বার্থে। এসবের প্রয়োজন ছিল। এ প্রকল্পগুলো সরাসরি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল এসবই বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রীলঙ্কা বেহিসাবি ঋণ নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার ঋণের হার এখন জিডিপির ১১৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটি এক বছরে যা উৎপাদন করে তার তুলনায় ঋণ বেশি। সেদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ঋণ গ্রহণে সংযত ও সতর্ক। বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ। কাজেই ঋণ গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ কখনো ঋণখেলাপি হয়নি, হবেও না।’ শ্রীলঙ্কার আজকের অবস্থার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা আছে। আছে ব্যাপক দুর্নীতি। কিন্তু অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণগুলো সস্তা দোষারোপের রাজনীতিতে আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় খাত হলো পর্যটন। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকেই পর্যটন খাতে বড় ধরনের সংকট চলছে। ২০১৯ সালে কলম্বোয় সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরণে মারা যান ২৫৩ জন। এর ফলে সারা বিশে^র পর্যটকরা শ্রীলঙ্কাবিমুখ হয়ে পড়েন। এ ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই বিশে^ করোনার প্রকোপ শুরু হয়। ফলে রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান খাত বাধাগ্রস্ত হয়। সেদিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত হলো গার্মেন্ট ও রেমিট্যান্স। বিশে^ করোনার প্রকল্প শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এ প্রণোদনায় পোশাক খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। পোশাক খাতের প্রতি এ পক্ষপাত নিয়ে অনেকে সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু এখন প্রমাণ হয়েছে পোশাক খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত দরকারি ছিল। করোনার মধ্যেও আমাদের প্রবাসী ভাইবোনেরা রেমিট্যান্স পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ করোনার মধ্যেও বাংলাদেশে রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমেনি। যে কারণে শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশে^র অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো। সংহত।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ভরাডুবির আরেকটি বড় কারণ জনপ্রিয়তা লাভের ভ্রান্ত ও সস্তা কৌশল। জনগণের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য অনেক সময় রাজনৈতিক দল এবং সরকার কিছু মুখরোচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে সিদ্ধান্তগুলো প্রায়ই আত্মঘাতী হয়। এ রকমই একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় গোতাবায়া ভ্যাট ১৫ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনেন। ২ শতাংশ নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স বন্ধ করে দেন। শ্রীলঙ্কায় আয়করব্যবস্থায় চমৎকার একটি পদ্ধতি ছিল। পে অ্যাজ ইউ আর্ন (পিএইউই)। জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে এ ব্যবস্থাও বিলুপ্ত করেন রাজাপক্ষ। এর ফলে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ আয় কমে যায়। দেশটি ঋণের ওপর ভর করে চলতে থাকে। এ ধারায় আজ শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আয় এখনো আশাব্যঞ্জক নয়। করব্যবস্থা এখনো ক্রটিপূর্ণ। এখনো বহু মানুষ আয়কর ঠিকঠাকমতো দেয় না। তার পরও রাজস্ব আয়ে রাজনৈতিক স্টান্টবাজি নেই। রাজস্ব আরও বাড়ানোর একটা তাগিদ আছে। এখনো বাজেটে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আমাদের প্রধান উৎস।
শ্রীলঙ্কা ট্র্যাজেডির একটি বড় কারণ হলো ভুল কৃষিনীতি। গত বছর গোতাবায়া সরকার অর্গানিক কৃষিবিপ্লব শুরু করেন। কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে কৃষি উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। খাদ্য আমদানি করতে হয়। এটি অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের চাপ ফেলে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও স্বস্তির নেপথ্যে নায়ক হলেন আমাদের কৃষক। করোনার মধ্যেও তাঁরা কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। ফলে খাদ্য সংকট হয়নি। বাংলাদেশ রাসায়নিক সারে ভর্তুকি দিয়েছে, যেন কৃষক কম মূল্যে সার কিনতে পারেন। আমাদের কৃষি আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতির শক্তিশালী মেরুদণ্ড। বাংলাদেশের অগ্রগতির ভিত্তি হলো কৃষি।
আরেকটি কারণ শ্রীলঙ্কার সংকটের জন্য সরাসরি দায়ী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব যে দেশগুলোয় পড়েছে তার মধ্যে শ্রীলঙ্কা অন্যতম। যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের পর্যটকদের শ্রীলঙ্কায় আসা বন্ধ হয়েছে। এ যুদ্ধ ছিল শ্রীলঙ্কার জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
কাজেই শ্রীলঙ্কার ঘটনার পর যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন বেলুন ফুটবে বলে গবেষণা করছেন তাদের শিগগিরই হতাশ হতে হবে। বাংলাদেশ কখনো শ্রীলঙ্কা হবে না। তবে শ্রীলঙ্কা উন্নয়নে সংগ্রামরত দেশগুলোর জন্য একটি বড় শিক্ষা। এ শিক্ষা যত দ্রুত নেওয়া যায় ততই মঙ্গল। এই যেমন ভারত। শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতির পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শীর্ষ আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সে বৈঠকে আমলারা মোদিকে সতর্ক করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘ভোটে জিততে অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি যেন না দেওয়া হয়।’ অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভারতের পরিস্থিতিও অচিরেই শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী মঙ্গলবার একনেকের বৈঠকের পর বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলাবেন না।’ পরিকল্পনামন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। তার পরও শ্রীলঙ্কার ঘটনার পর কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের সজাগ ও সতর্ক থাকতেই হবে। একটি প্রকল্প যদি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হয় তাহলে ওই প্রকল্প অনেক ক্ষেত্রেই বোঝা হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কায় দেখা গেছে অধিকাংশ প্রকল্পই সময়ে শেষ হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। ফলে ঋণের সুদ বেড়েছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই ঋণ শোধ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও অনেক ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি ঘটছে। প্রকল্প ব্যয় বারবার বৃদ্ধি বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় ব্যাধি। এ নিয়ে একাধিকবার খোদ প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ জানিয়েছেন। প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে দুর্নীতি। বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই করতে হলে প্রকল্প ব্যয় বারবার বাড়ানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়, ব্যয় বৃদ্ধি ও দুর্নীতি জনগণের ওপরও বোঝা হয়ে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, মেগা প্রকল্প, বড় উন্নয়নে নজর দিতে গিয়ে যেন নাগরিকদের ছোট ছোট সুযোগ-সুবিধাগুলো উপেক্ষিত না হয়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এবার রোজার কথাই ধরা যাক। যে দেশে এত উন্নয়ন, সে দেশে রোজার শুরুর দিন থেকেই বাসাবাড়িতে গ্যাসের চুলা জ¦লবে না কেন? কেন সিএনজি স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল মানুষের কাছে উন্নয়ন যেন চুপসানো বেলুন। বাজারে দিশাহারা মানুষের কাছে মাথাপিছু আয় স্রেফ কিছু সংখ্যাতত্ত্বের অপ্রয়োজনীয় হিসাব। যানজটে অচল হয়ে থাকা মানুষের জন্য মেট্রোরেল এক ধরনের তামাশা। তাই মানুষের আবেগ যেন ক্ষোভের আগুনে জ্বলে না ওঠে, সেটা লক্ষ্য রাখাও উন্নয়নের একটি চ্যালেঞ্জ। বড় অর্জনগুলো যেন ছোট ছোট বিচ্যুতিতে ম্লান না হয়। উন্নয়ন এবং জনগণ যখন একবিন্দুতে মিলিত হয় তখনই দেশ এগিয়ে যায়। উন্নয়ন ও জনগণ যখন প্রতিপক্ষ হয় তখন মানুষ উন্নয়নকে প্রতিপক্ষ মনে করে। তাই শুধু মেগা প্রকল্প নয়, মানুষের ছোট ছোট স্বস্তি, নিরাপত্তা, সুখের দিকেও নজর রাখতে হবে। না হলে বড় উন্নয়নের পরও মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে মানুষের সুখ, মানুষের হাসির চেয়ে একটি রাষ্ট্রের বড় উন্নয়ন অর্জন আর কিছুই নয়। মেগা প্রকল্পে আমরা মানুষকে ভুলে না যাই। শ্রীলঙ্কার উন্নয়ন ট্র্যাজেডির মূল কারণ জনবিচ্ছিন্নতা। জনবিচ্ছিন্ন একটি সরকারই এভাবে অপরিকল্পিত অপ্রয়োজনীয় উন্নয়নে নিজের আখের গোছাতে চায়। এর ফলে ঘটে সর্বনাশ। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে আমাদের একজন শেখ হাসিনা আছেন। যিনি প্রতি মুহূর্তে জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন। জনগণের মনের ভাষা পড়তে পারেন। জনগণের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তাই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না কখনো। বাংলাদেশ ব্যর্থও হবে না।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
Email : [email protected] সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন